বাংলাদেশ যেভাবে পাউন্ড থেকে ডলারে গেল
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় বিশ্ব অর্থনীতি কিন্তু মোটেই ভালো ছিল না। বিশ্ব অর্থনীতি তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের স্বর্ণযুগ পেছনে ফেলে দিয়েছে। সত্তরের দশক শুরুই হয় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে। জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা, দুই শিবিরে বিভক্ত পৃথিবী—এই ছিল সত্তরের দশকের বিশ্ব। এ রকম এক সময়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
বিশেষ এক বৈঠক
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয় নতুন একটি দেশ। গল্পটা ঠিক পরের দিনের। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে বসল বিশেষ এক বৈঠক। শিল্পোন্নত ১০টি দেশের অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নররা বসলেন এই বৈঠকে। ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এই বৈঠক।
মূলত ব্রেটনউডস ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষভাবে স্বর্ণকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় সব মুদ্রাই মার্কিন ডলারে রূপান্তরযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। একে বলা হয় স্বর্ণ মানের ব্রেটনউডস সংস্করণ।
এর আগে অবশ্য আরেকটি বৈঠকের কথা বলা প্রয়োজন। বৈঠকটি শুরু হয়েছিল ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই। বৈঠকটি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই নিউ হ্যাম্পশায়ারের শহর ব্রেটনউডসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকটি চলে ২২ জুলাই পর্যন্ত। মূলত নয়া আর্থিক ব্যবস্থার রূপরেখা কেমন হবে, এ নিয়েই বসেছিল বৈঠকটি। তীব্র মতানৈক্যের পর যে রূপরেখাটি চূড়ান্ত হয়, তার নাম ছিল ব্রেটনউডস ফাইনাল অ্যাক্ট।
ব্রেটনউডস ব্যবস্থায় বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ‘পার ভ্যালু’ সম্পর্কে তিনটি বিধান রাখা হয়। যেমন—
১. প্রতিটি দেশ মার্কিন ডলারের সঙ্গে তাদের পার ভ্যালু বা বিনিময় হার ঘোষণা করবে।
২. এভাবে ঘোষিত পার ভ্যালুর উভয় পাশে দেশীয় মুদ্রার বিনিময় হারের হেরফের ১ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে।
৩. আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন ছাড়া পার ভ্যালু পরিবর্তন করা যাবে না। মূলত ১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মার্কিন ডলারের বিনিময় হারকেই সব সদস্যদেশ তাদের প্রাথমিক পার ভ্যালু হিসেবে বেছে নেয়।
মূলত ব্রেটনউডস ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে মার্কিন ডলার এবং পরোক্ষভাবে স্বর্ণকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থায় সব মুদ্রাই মার্কিন ডলারে রূপান্তরযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়। একে বলা হয় স্বর্ণ মানের ব্রেটনউডস সংস্করণ। এই ব্যবস্থায় মুদ্রার অবমূল্যায়নেরও সুযোগ রাখা হলো না। সত্তরের অর্থনৈতিক সংকটের সময় দেখা গেল, এই ব্যবস্থা আর কাজ করছে না। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটে মার্কিন ডলার স্বর্ণে রূপান্তরের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
এরপর ১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ব্রেটনউডস ব্যবস্থা বাতিল করে দিলে নতুন সংকট তৈরি হয়। মার্কিন ডলার স্বর্ণে রূপান্তরের ক্ষমতা বাতিল করার এই পদক্ষেপকে বলা হয় ‘গোল্ডেন উইন্ডো’ বন্ধ করা, যাকে অনেকে ‘নিক্সন শক’ বলে থাকেন। এর প্রেক্ষাপটেই ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বরের বৈঠকটি বসে। এই বৈঠকে নতুন করে সমঝোতা হলেও তা ১৫ মাসের বেশি থাকেনি। যে যার মতো করে বিনিময় ব্যবস্থা অনুসরণ করা শুরু করে, বিশ্ব যাত্রা শুরু করে ফ্লোটিং বা ভাসমান বিনিময় হারের দিকে।
বাংলাদেশে যেভাবে শুরু
এবার বাংলাদেশে ফেরা যাক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার সংকট তো ছিলই। নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আরেকটি সমস্যা হচ্ছে, নতুন দেশের মুদ্রাও নতুন। এখন এর বিনিময় হার কী হবে, আর মধ্যবর্তী মুদ্রা বা কারেন্সিই-বা (ইন্টারভেনশন কারেন্সি) কী হবে।
স্বাধীনতার ঠিক আগে এ দেশের মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং। আর সরকারি বিনিময় হার ছিল পাউন্ডপ্রতি ১৩ দশমিক ৪৩ টাকা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আর পাকিস্তান আমলের বিনিময় হার ধরে রাখেনি। বরং প্রতিবেশী ভারতের মুদ্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা হয় পাউন্ডপ্রতি ১৮ দশমিক ৯৬৭৭ টাকা। তবে মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিংকেই ধরে রাখে। ব্রিটিশ উপনিবেশের স্মৃতি হয়তো তখনো ভুলতে পারেনি কেউ। কেননা, তখন কিন্তু গুরুত্ব হারাচ্ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড। অনেক দেশই তখন ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে সরে যাচ্ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করে প্রায় ৫৮ শতাংশ। এতে নতুন বিনিময় হার দাঁড়ায় প্রতি পাউন্ড ৩০ টাকায়। বলাই বাহুল্য, আইএমএফের পরামর্শে মুদ্রার এত বড় অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল।
শুরু থেকেই বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভালো ছিল না। অর্থনৈতিক সংকটে টাকার মূল্যমান ক্রমেই হ্রাস পায়। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ তেলসংকট নিয়ে আসে। মুদ্রাস্ফীতি লাগামছাড়া হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও দেখা দেয় খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ। খাদ্য আমদানিতে টান পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। টাকার মান কমতেই থাকে। সরকারের ঠিক করা বিনিময় হার আর খোলা বাজারে বা বেসরকারি হারের পার্থক্য ছিল বিশাল। যেমন ১৯৭৫ খোলা বাজারে তখন পাউন্ডের বিনিময় মূল্য ছিল প্রায় ৬০ টাকা।
এ অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করে প্রায় ৫৮ শতাংশ। এতে নতুন বিনিময় হার দাঁড়ায় প্রতি পাউন্ড ৩০ টাকায়। বলাই বাহুল্য, আইএমএফের পরামর্শে মুদ্রার এত বড় অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশ অসংখ্যবার টাকার অবমূল্যায়ন করলেও তা অল্প অল্প মাত্রায়। একবারে ৫৮ শতাংশের মতো অবমূল্যায়নের পথে আর কখনো যায়নি বাংলাদেশ।
ভাসমান বিনিময় হারের পথে
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রিত ভাসমান বা ফ্লোটিং বিনিময় মুদ্রা নীতির প্রচলন করে। তবে মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসে ১৯৮৩ সালে। এ সময় মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বেছে নেওয়া হয়। প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার বা রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল রাখতে মুদ্রা বাস্কেটে ব্রিটিশ পাউন্ডসহ উল্লেখযোগ্য মুদ্রাগুলো রাখা হয়। এ সময় আনুষ্ঠানিক বা অফিশিয়াল বিনিময় মুদ্রা হারের পাশাপাশি বাজারভিত্তিক সেকেন্ডারি বিনিময় মুদ্রা বাজার চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। তখন দেশে কার্ব মার্কেটের উদ্ভব হয়।
১৯৯৩ সালের ১৭ জুলাই নেওয়া হয় বিনিময় হারের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশি মুদ্রাকে চলতি হিসাবে রূপান্তরযোগ্য করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের আংশিক উন্মুক্তকরণের সূচনা হয়। সে সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার বিপরীতে ডলারের জন্য প্রযোজ্য মধ্যবর্তী দর নির্ধারণ করে দিত এবং অনুমোদিত ডিলারদের জন্য ক্রয়-বিক্রয় হার নির্ধারণ করে দিত। আর ২০০৩ সালের মে থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়। এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বাজার বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়। এর অর্থ চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঠিক হয় মুদ্রার বিনিময় হার। তবে এখনো মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। এ জন্য তারা সরাসরি আর হস্তক্ষেপ করে না। বরং নিজেই মুদ্রা বাজারে কেনাবেচার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করে থাকে। এমনটাই হচ্ছে এখন।
No comments