চিকিৎসায় বড় অবদান বেসরকারি খাতের
দেশের সিংহভাগ মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে বেসরকারি খাত থেকে। সেবার গুণগত মান বাড়াতে সব বিকল্প দেখার পরামর্শ জনস্বাস্থ্যবিদের।
দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৩৯। শয্যাসংখ্যা ৬৭ হাজার ৭৩৫।
বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৭৭। শয্যাসংখ্যা ৯৪ হাজার ৩৯০।
২৪ বছরে বেসরকারি হাসপাতাল বেড়েছে ৯০০ শতাংশ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পর চিকিৎসা চিত্রে বেশ পরিবর্তন এসেছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক, কবিরাজ, বৈদ্য, ওঝা ও গ্রাম্য চিকিৎসকদের রোগী কমলেও তারা এখনো আছে। বাড়ি গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার খবর এখন কম শোনা যায়। সরকারি চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা আগের মতোই আছে। বেড়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের সংখ্যা।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালের সংখ্যা ও শয্যাসংখ্যা এখন অনেক বেশি। একই সঙ্গে রোগনির্ণয়ের সুযোগ এখন বেসরকারি খাতেই বেশি। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত সরকারি খাতের চেয়ে এগিয়ে।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় বিনা মূল্যে। রোগনির্ণয় পরীক্ষার ফি সরকারি হাসপাতালে অনেক কম। তা হলে বাংলাদেশের মানুষ ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্লিনিকের দিকে ঝুঁকল কেন? অথবা কেন শত শত বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে উঠল?
পেছনের কারণ
জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ছাড়াও আর্থসামাজিক আরও কিছু কারণ আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে।
সরকারি হাসপাতালে সেবার মান নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট নয়—ধারণা অনেকের। ১৯৯৯ সালে ৩৭ শতাংশ মানুষ মনে করত, সরকারি হাসপাতালে সেবা ‘ভালো’। ২০০৩ সালে তা কমে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়। সরকারি হাসপাতালে অনিয়ম, দুর্নীতি হয়, এটা মানুষ জানে। কিছু ক্ষেত্রে সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির ঘাটতি থাকে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিচ্ছন্ন। এসব কারণে সরকারি হাসপাতালের ওপর মানুষের আস্থা অনেক কম।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্লিনিক ও হাসপাতাল গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসা খাতে ব্যয় করার সামর্থ্যও বেড়েছে। অন্য কারণটি হচ্ছে, সরকারি সমর্থন ও সহযোগিতা। ক্ষমতায় থাকা বিভিন্ন সরকার দেশের উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বেসরকারি খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন সময় আর্থিক প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা দিয়েছে। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের মালিকেরা সেই সুবিধাও পেয়েছেন।
অবদান অনেক বড়
৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে দেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৩৯। এর মধ্যে আছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা বা সদর হাসপাতাল, মাতৃ ও শিশুসদন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে মোট শয্যাসংখ্যা ৬৭ হাজার ৭৩৫।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নিবন্ধিত বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৭৭। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ৯৪ হাজার ৩৯০।
এর বাইরে সারা দেশে নিবন্ধিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা রোগনির্ণয় কেন্দ্র আছে ১০ হাজার ৭২৭টি ও ব্লাড ব্যাংক আছে ১৪০টি। তবে প্রতিষ্ঠিত ধারণা হচ্ছে, নিবন্ধন ছাড়াও দেশে অনেক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে এবং সেখান থেকে মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কত বেড়েছে, তা বোঝা যায় বিশ্বব্যাংকের একটি দলিলে। ২০০৫ সালে প্রকাশিত ওই দলিল বলছে, ১৯৯৭ সালে দেশে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছিল মাত্র ৬১৩টি, শয্যাসংখ্যা ছিল ১১ হাজার ৩৭১। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিল ১ হাজার ৪২টি। ২৪ বছরে বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল বেড়েছে ৯০০ শতাংশ।
করোনা মহামারির সময়েও সেবা দিতে পিছপা হয়নি বেসরকারি হাসপাতালগুলো। সরকার যেসব প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানই করোনা পরীক্ষা ও করোনা রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ভাইস চেয়ার ড. তৌফিক জোয়ার্দার প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা যাবে না। এই খাতের কিছু সীমাবদ্ধতা, কিছু অসংগতির কথা শোনা যায়। শুধু নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা বজায় রেখে তা দূর করা যাবে না। চিকিৎসার মান বাড়াতে অন্য বিকল্পও ভেবে দেখতে হবে।
No comments