করোনাকালে মানসিক সমস্যা বেড়েছে, ৭৪ শতাংশ শিশু–তরুণ চিকিৎসা নেয়নি
করোনাকালে নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে অনেক শিশু ও তরুণ উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে তাদের এই মানসিক সমস্যা যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত, ততটা পায়নি পরিবারের কাছে। দীর্ঘদিন শারীরিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকা শিশু–তরুণদের মানসিক অবস্থা শিক্ষকদের কাছেও তত গুরুত্ব পায়নি।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীতে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সংকট তুলে ধরে এসব কথা বলেন। তাঁদের মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিশু–তরুণদের দক্ষতার সঙ্গে বেড়ে উঠতে এলাকাভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগ বাড়াতে হবে। মানসিক সমস্যাকে অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করে সচেতনতা বাড়াতে এলাকায় এলাকায় পরামর্শক (প্যারা কাউন্সেলর) নিয়োগ দিতে হবে।
‘কোভিড-উত্তর বাংলাদেশে শিশু ও তরুণদের কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন’ শিরোনামের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন ও ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশন।
শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রকল্পের আওতায় আয়োজক সংগঠনগুলো পরিচালিত একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরে গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ৭৪ শতাংশ শিশু ও তরুণ কোনো চিকিৎসা নেননি। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের বেশির ভাগই জানেন না তার এলাকায় মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য কোথায় সেবা পাওয়া যাবে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, কোভিড তাদের শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করেছে। ২৫ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের জীবনের আনন্দ-বিনোদনের ওপর প্রভাব ফেলেছে কোভিড। গত বছরের অক্টোবর–নভেম্বরে পরিচালিত জরিপে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার ৪টি ওয়ার্ড, যশোর সিটি করপোরেশনের ৪টি ওয়ার্ড ও একটি ইউনিয়ন পরিষদ এবং বাগেরহাট জেলার ৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ৬০০ জন অংশ নেন। পাশাপাশি কথা বলা হয় সমানসংখ্যক অভিভাবকের সঙ্গে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী মূল প্রবন্ধ ও জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, দেশে ৩০ হাজার মানসিক রোগীর জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। স্বাস্থ্য বাজেটের ১ শতাংশের কম বরাদ্দ রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। বেশিসংখ্যক মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করা গেলে চাহিদা ও সেবার মধ্যে ভারসাম্য আসবে। সমাজে করোনা মহামারিতে সৃষ্ট অসমতা মানুষের মধ্যে দুর্বলতা তৈরি করেছে। এটা মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আলোচনায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান বলেন, মানসিক সমস্যা নিয়ে সমাজে–পরিবারে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। যতক্ষণ পারা যায় তারা চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে পরিবারগুলো নিজেরা সমাধানের চেষ্টা করে। পরিবার থেকে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের মতো করে কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। সরকার মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় জনবল বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, মানসিক সমস্যা প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা জরুরি। আর এ প্রতিরোধ শুরু করতে হবে পরিবার পর্যায় থেকে। মানসিক সমস্যাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত না করা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না। মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে দুটো উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে মডেল প্রকল্প নেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জন্য আইন ও কৌশলগত যেসব উপকরণ ও প্রস্তুতি প্রয়োজন, তার সবই দেশে রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে দেখতে হবে বড় প্রেক্ষাপটে। কোন প্রেক্ষাপটে কী পদক্ষেপ নিলে সমাধান আসবে, তা বের করে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্যে অসমতা ও বৈষম্যের প্রভাব করোনাকালে আরও স্পষ্ট হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, কোভিডের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো দক্ষতা শিশু–কিশোরদের থাকবে না। তাই পরিবার ও সমাজের উচিত বৈষম্যহীনভাবে এই শিশুদের যথাযথভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা এবং তাদের মানসিক সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বাংলাদেশের জাতীয় পরামর্শক (মানসিক স্বাস্থ্য) হাসিনা মমতাজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং লোকজনকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন প্রোগ্রামের পরিচালক মোর্শেদা চৌধুরী বলেন, মানসিক রোগী অনুসারে দক্ষ চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি পূরণে মধ্যবর্তী সময়ের জন্য সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে এলাকাভিত্তিক ‘প্যারা কাউন্সেলর’ নিয়োগ করা যেতে পারে। মানুষ মানসিক চিকিৎসার জন্য কোথায়, কার কাছে যাবে, তা জানাবে এই প্যারা কাউন্সেলররা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জোবেদা খাতুন বলেন, মানসিক বিকাশের জন্য যেসব চাহিদা প্রয়োজন, তা শনাক্ত করতে পারছেন না মা–বাবা। অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে, কিছু বুঝে ওঠার আগে শিক্ষার্থীদের ওপর পড়াশোনার চাপ তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যাতে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সে জন্য শিক্ষকদেরও সংবেদনশীল হতে হবে।
ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান বলেন, বিভিন্ন মডেল প্রকল্পের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পেশাদারদের সহায়তা নিতে সমাজের লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান বলেন, পরিবারে প্রত্যেক শিশুকে সমানভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, যাতে সে মানসিক সুস্থতা নিয়ে বড় হতে পারে।
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, দিন দিন প্রাত্যহিক জীবনে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ বাড়ছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যহানি ঘটাচ্ছে। করোনাকালে সমস্যাগুলো আরও বেড়েছে।
যশোর থেকে অংশগ্রহণকারী নাসরিন, ঢাকা থেকে মুক্তি প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার সদস্য রফিক মৃধা এবং ডিজঅ্যাবলড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের সদস্য শিরিন আকতার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
No comments