Breaking News

ফাইভ-জি বাংলাদেশে যে সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে

ফাইভ-জি বাংলাদেশে যে সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে

১২ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে বাংলাদেশ ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় এল। বিজয়ের মাস, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিরাট অর্জন। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ছয়-সাতটি দেশ এ প্রযুক্তির আওতায় এসেছে। মুঠোফোনের পঞ্চম জেনারেশন ইন্টারনেটকে সংক্ষেপে ডাকা হয় ফাইভ-জি। বর্তমানে চলমান ফোর-জি এলটিই (লং টার্ম ইভল্যুশন) নেটওয়ার্কের আপগ্রেড ভার্সনকে ফাইভ-জি বলে।

এলটিই বলতে মুঠোফোন এবং ডাটা টার্মিনালগুলোর উচ্চগতির তথ্য আদান-প্রদানে বেতার যোগাযোগকে বোঝায়। এ প্রযুক্তিতে ল্যাটেন্সি কম হওয়ায় বাড়বে নেটওয়ার্ক রেসপন্স। ল্যাটেন্সি বলতে কোনো সাইট অ্যাকসেস করা এবং তার রেসপন্স করার মধ্যবর্তী সময়কে বোঝায়। ফোর-জির চেয়ে ফাইভ–জি নেটওয়ার্কে ১০ গুণ বেশি দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার এমবিপিএস গতিতে ডাউনলোড করা যাবে।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন

গতির এই হিসাব প্রথম শুরু হয় ওয়ান–জি দিয়ে ১৯৭৯ সালে এনালগ পদ্ধতির মাধ্যমে, যেখানে দুটি ডিভাইসের মধ্যে শুধু কল করা যেত। এরপর আসে টু–জি (১৯৯১ সালে)।

এখানে দুটি মুঠোফোন ডিভাইসের মধ্যে কল করার পাশাপাশি টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো সম্ভব হতো। তারপর আসে থ্রি–জি (১৯৯৮ সালে), যা টেক্সট ম্যাসেজ, কল, ইন্টারনেট ইত্যাদির সঙ্গে ব্রাউজ করার সুবিধা ছিল। থ্রি–জির সব সুবিধাসহ ফোর–জি আসে ২০১০ সালে। এতে সহজেই একসঙ্গে অনেকগুলো ডিভাইস কানেক্ট করা এবং যেকোনো বড় সাইজের ফাইল শেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয়। পরে ফোর–জিকে আরও দ্রুত করার জন্য এলটিই প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হয় এবং ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা অন্যান্য মুঠোফোন যন্ত্রে মুঠোফোন ব্রডব্যান্ড, মুঠোফোন আলট্রা ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট সেবা অন্তর্ভুক্ত হয়।

ফোর–জি নেটওয়ার্কে আরও যেসব সুবিধা বিদ্যমান, সেগুলোর মধ্যে সংশোধিত মুঠোফোন ওয়েব সেবা, আইপি টেলিফোন, গেমিং, এইচডিটিভি, হাইডেফিনেশন মুঠোফোন টিভি, ভিডিও কনফারেন্স, ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জুনে মুঠোফোনে ফোর–জি (এলটিই) সেবা শুরু হয়। ফাইভ–জি প্রযুক্তিতে অনেকগুলো ডিভাইসকে একত্রে কানেক্ট (ইন্টারনেট অফ থিংস এর মতো) করে রাখার জন্য বিশেষ প্রযুক্তিসহ এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে বেশি ব্যান্ডউইথ কন্ট্রোল করার ক্ষমতা রাখে। আর মূলত এ বিষয়ের ওপর লক্ষ্য করেই ফাইভ-জি প্রযুক্তির যাত্রা শুরু।

থ্রি–জি বা ফোর–জির মতো ফাইভ–জি প্রযুক্তি শুধু মুঠোফোন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয় বরং ওয়াই–ফাই এর মতো যেকোনো ডিভাইসেও থাকতে পারবে, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সবাইকে সংযুক্ত করতে সক্ষম হবে এবং মেশিন, অবজেক্ট ও ডিভাইসগুলোকে একই সূত্রে গাঁথবে। এমনকি পারসোনাল কম্পিউটারেও একটি চিপ লাগানো যাবে। ফলে তথ্য আদান-প্রদান, ভিডিও কল, কল কনফারেন্স এবং ইন্টারনেটভিত্তিক সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

ফাইভ–জি সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সব কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে, ফলে কাস্টমার সার্ভিস হয়ে উঠবে আরও সন্তোষজনক। এককথায় বলা যায়, গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দেবে। এত সুবিধা নিয়ে প্রথম যে দেশে ফাইভ–জি টেকনোলজি চালু করা হয়েছিল, তা হলো দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৯ সালে।

ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, হাই রেজল্যুশন ভিডিও দেখা, চালকবিহীন গাড়ি, প্লেন চালানোর ট্রেনিং থেকে শুরু করে নানা গবেষণা কর্ম, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধারকাজে ড্রোন ব্যবহার করা সম্ভব হবে। গুগল ম্যাপ ব্যবহারেও অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। লোকেশন ট্র্যাকিং করার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হবে না, মিলি সেকেন্ডের মধ্যে ফলাফল দেবে। এমনকি উচ্চ ক্ষমতার এই মুঠোফোন ইন্টারনেটের মাধ্যমে রোবট, সেন্সর বা অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্যেও ব্যবহৃত হবে। এর প্রভাব দেখা যাবে সব ক্ষেত্রে—আমাদের জীবনে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি খেলাধুলায়ও। ফাইভ–জি সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সব কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে, ফলে কাস্টমার সার্ভিস হয়ে উঠবে আরও সন্তোষজনক। এককথায় বলা যায়, গোটা সমাজটাকেই পরিবর্তন করে দেবে। এত সুবিধা নিয়ে প্রথম যে দেশে ফাইভ–জি টেকনোলজি চালু করা হয়েছিল, তা হলো দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৯ সালে।

ফাইভ–জি হাই ব্যান্ডউইথ হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা থাকার কারণে অদূর ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি শুধু মুঠোফোন ইন্টারনেট নয়, বরং হোম ইন্টারনেটেও নিজের জায়গা দখল করে নেবে। গ্রামীণ, পাহাড়ি ও বিচ্ছিন্ন এলাকায় এখনো উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছেনি কারণ, ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো লোকসানের আশঙ্কায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্রডব্যান্ড কেব্ল বা ফাইবার অপটিক কেব্ল স্থাপন করেনি সেখানে। ফাইভ–জি প্রযুক্তি চলে আসার পর ওই সব এলাকার লোকেরাও গিগাবাইট/সেকেন্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুবিধা পাবে এবং ইন্টারনেট অপারেটরদেরও আর মাটির নিচ দিয়ে কিংবা ওপর দিয়ে কেবল টানানোর প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে থাকবে মাত্র ১ মিলি সেকেন্ডের ল্যাটেন্সি এবং এটি ৯০ শতাংশ কম এনার্জি ব্যয় করে কাজ করবে। ডেটা ট্রান্সমিশনে সাধারণত ৩ দশমিক ৫ থেকে ২৬ গিগাহার্টজের মতো উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের অনেক ক্ষমতা থাকে। কিন্তু স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কারণে তাদের আওতা কম থাকে, ফলে সামনে কোনো বাধা পেয়ে আটকে যায়।

ফাইভ–জির প্রযুক্তিতে এ সমস্যা একেবারেই থাকবে না। কারণ, এটি এমন একটি নতুন রেডিও প্রযুক্তি, যা রেডিও তরঙ্গের ব্যবহার আরও বেশি নিশ্চিত করবে এবং একই সময় একই স্থানে বেশি মুঠোফোন ইন্টারনেটের সুবিধা নিতে পারবে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে, অনলাইন এডুকেশনে এক যুগান্তকারী বিপ্লব নিয়ে আসবে। স্বাস্থ্য খাতেও ব্যাপক রদবদল ঘটাবে। মেডিকেল ডিভাইসের সঙ্গে ফাইভ–জি সিম ব্যবহার করে ডাক্তার দূরের কোনো রোগীকে শহরে বসেই জরুরি চিকিৎসা দিতে পারবেন। এমনকি রোবোটিক সিস্টেমের সাহায্যে রিমোট সার্জারি করতে পারবেন।

সর্বত্র ফাইভ-জি চালু হলে দূরে থেকেও ঘরের লাইট, ফ্যান, এসি ও কৃষিক্ষেত্রে পানির পাম্প চালু বা বন্ধ, পুকুরে মৎস্য চাষ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে (ইন্টারনেট অফ থিংস এর মতো)। ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু হলে টিভি চ্যানেলগুলো দেখার জন্য ডিসের প্রয়োজন হবে না।

বডি ফিটনেস ডিভাইস নিজের শরীরের সঙ্গে ব্যবহার করে বডি থেকে সিগন্যাল পাঠাতে মিলি সেকেন্ড সময় লাগবে। গাড়ির লোকেশন, স্পিড, ডেস্টিনেশনসহ ট্রাফিকের সব ইনফরমেশন হাতের মুঠোয় চলে আসবে ফলে ড্রাইভিং, গাড়ি দুর্ঘটনা কমাতে সহায়ক হবে। গেমিং এক্সপেরিয়েন্সকে আরও সুখময় করে তুলবে। বিশেষ করে, অনলাইন গেমগুলোকে সবার কাছে অবাধ করে তুলবে ফলে মুঠোফোন গেমিং ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর বিস্তার ঘটবে।

প্রাথমিকভাবে রাজধানী ঢাকার ২০০টি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে এই ইন্টারনেট পরিষেবা চালু হবে। ঢাকার গণভবন, বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানাসহ কিছু বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকাকে এ পরিষেবার আওতায় আনা হবে। সর্বত্র ফাইভ-জি চালু হলে দূরে থেকেও ঘরের লাইট, ফ্যান, এসি ও কৃষিক্ষেত্রে পানির পাম্প চালু বা বন্ধ, পুকুরে মৎস্য চাষ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে (ইন্টারনেট অফ থিংস এর মতো)। ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু হলে টিভি চ্যানেলগুলো দেখার জন্য ডিসের প্রয়োজন হবে না। কম্পিউটারে থাকা ফাইভ–জি চিপ থেকে ডেটা ট্রান্সমিট করে ফোনে, ট্যাবলেটে, টিভিতে ডেটা সিংক করা সম্ভব হবে।

আবার একটি গেমিং কনসোল দিয়ে একসঙ্গে একাধিক টিভি চালানো যাবে অনায়াসেই। ঘরের ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদি প্রযুক্তির আওতায় থাকবে। ফলে জনপ্রিয় হবে স্মার্ট হোম, স্মার্ট সিটি, সেলফ ড্রাইভিং কার, হেলথ মনিটরিং ডিভাইস আর অগমেন্টেড রিয়েলিটির মতো ডিভাইসগুলো। চোখের পলক পড়ার পূর্বেই কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিকাশ ঘটবে ফাইভ-জির কল্যাণে অনায়াসেই। তবে এসব সুবিধা পেতে হলে বিদ্যমান টাওয়ারগুলো ফাইভ-জিতে রূপান্তর করতে হবে এবং গ্রাহকদের লাগবে সেই উপযোগী হ্যান্ডসেট। আর দ্রুতগতির বিষয়টি নির্ভর করবে কোনো স্পেকট্রাম ব্যান্ডে ফাইভ-জি ব্যবহার করা হবে এবং মুঠোফোন কোম্পানিগুলো ট্রান্সমিটারের পেছনে কতটা বিনিয়োগ করবে। কর্তৃপক্ষকেও উদ্যোগ নিতে হবে ফাইভ-জি টেকনোলজির উপযোগী সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার প্রটোকল নির্ধারণ করা।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি এর অধ্যাপক।

 

No comments