পিঠ বাঁচাতেই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছেন কোহলি
টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে অধিনায়কত্ব ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই ভারতের টেস্ট দলের অধিনায়কত্বও ছেড়ে দিয়েছেন বিরাট কোহলি। কেউ পেছনে তাকিয়ে কোহলির প্রশংসায় মেতেছেন। তাঁর অধীন ভারতের ক্রিকেট দল কোন কোন দিকে বেশি ভালো করেছে, সেসব উঠে আসছে বিশ্লেষণে। অনেকে অবশ্য এভাবে একের পর এক সব সংস্করণের নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ায় কোহলির সমালোচনাও করছেন।
ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার সঞ্জয় মাঞ্জরেকারও অনেকটা কোহলির সমালোচনার সুরেই কথা বলেছেন। তাঁর চোখে, কোহলি অনেকটা পিঠ বাঁচাতে এমন করেছেন। অর্থাৎ তাঁকে কেউ টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার আগে নিজেই সরে গেছেন। অধিনায়কত্ব নিয়ে চাপের মুখে পড়লেই কোহলি এভাবে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন বলে মনে হচ্ছে মাঞ্জরেকারের।
অধিনায়কত্বের বিচারে পাঁচ মাসের মধ্যেই কীভাবে সব হারালেন কোহলি! কিছু তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে আর কিছু হারানোর সিদ্ধান্ত কোহলি নিজেই নিয়েছেন। মাস পাঁচেক আগেও ভারতের তিন সংস্করণের দলের পাশাপাশি আইপিএলে নিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুরও অধিনায়ক ছিলেন কোহলি।
কিন্তু সর্বশেষ আইপিএলে বেঙ্গালুরুর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন কোহলি, পাশাপাশি জানিয়ে দেন অক্টোবর-নভেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হয়ে যাওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারতের টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্বও ছেড়ে দেবেন।
বয়স যে খুব বেশি হয়ে গেছে এমন নয়, ৩৩তম জন্মদিনের কেক কাটলেন মাস তিনেক আগে। কিন্তু কোহলি তখন ছোট সংস্করণের ক্রিকেটে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজি ও জাতীয় দল—দুটিরই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে জানান, একসঙ্গে ভারতের তিন সংস্করণের দল ও আইপিএলের নেতৃত্ব তাঁর জন্য চাপ হয়ে যাচ্ছে।
তখন পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তটাকে যৌক্তিকই মনে হচ্ছিল। কোহলি ও তাঁর বলিউড অভিনেত্রী স্ত্রী আনুশকা শর্মার পরিবারে নতুন অতিথি এসেছে, করোনাকালে প্রতিটি সিরিজ খেলার ধকল বেড়েছে। এর মধ্যে অধিনায়কত্বের চাপ একটু কমাতে চাইতেই পারেন কোহলি!
কিন্তু টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) কোহলিকে ওয়ানডের অধিনায়কত্ব থেকেও সরিয়ে দেয়। সদ্য শেষ হওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল ঘোষণার বিবৃতিতে জানিয়ে দেয়, কোহলির বদলে টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব পাওয়া রোহিত শর্মাই ভারতের ওয়ানডের অধিনায়কত্বও পাচ্ছেন। কোহলির হাতে ছিল টেস্ট অধিনায়কত্ব, দক্ষিণ আফ্রিকায় তিন টেস্টের সিরিজে ২-১ ব্যবধানে হেরে যাওয়ার পর সেটিও ছেড়ে দেন কোহলি।
শুধুই চাপ নাকি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারতের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া আগের কোচ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে মিলে তাঁর গড়ে নেওয়া ব্যবস্থা ছুটে যাওয়াতেই কোহলির এভাবে একের পর এক অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া? নাকি ভারতীয় বোর্ডের সঙ্গে, বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলীর সঙ্গে তাঁর মিলছে না? রোহিত শর্মার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্বের গুঞ্জন তো বছর তিনেক ধরেই সংবাদমাধ্যমে মুখরোচক খবর। সব মিলিয়ে কোহলির একের পর এক অধিনায়কত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্তের পেছনে মূল কারণ কী, সেটি শুধু কোহলিই জানেন। তবে চারপাশ থেকে এ নিয়ে আলোচনা থেমে নেই!
ক্রিকেট–বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতে মাঞ্জরেকারের চোখে, পিঠ বাঁচাতেই কোহলির এমন সিদ্ধান্ত, ‘খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক সিদ্ধান্তগুলো এসেছে। সাদা বলের পাশাপাশি আইপিএলের অধিনায়কত্বও ছেড়ে দিয়েছে ও। সেটাও অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে এখানে মজার ব্যাপার, এই তিন সংস্করণের অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একটার পর এক এত কম সময়ের মধ্যে এসেছে! আমার মনে হয়, ও নিজেকে অধিনায়কত্ব থেকে বরখাস্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে চাইছে। যখনই ওর মনে হয় ওর অধিনায়কত্ব চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে, ও সরে যায়।’
কোহলির এমন সিদ্ধান্তের পেছনে অনুঘটক কী কী হতে পারে, সেটিও নিজের ভাবনা থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন মাঞ্জরেকার, ‘কোহলির চারপাশ ঘিরে রাখা যে আবহ এত দিন ওকে নিজের মতো করে খেলতে, আলো ছড়াতে সাহায্য করেছে, (ভারতীয় দলের) সে আবহ বদলে যাচ্ছে। অনিল কুম্বলে কোচ হওয়ার পর ও অস্বস্তিতে ছিল। কিন্তু শাস্ত্রী ও তাঁর সহকারী কোচরা আসার পর ও (কোহলি) স্বস্তি পেয়েছে। নতুন কোচ (রাহুল দ্রাবিড়) তো আর রবি শাস্ত্রী নন। নতুন কোচের কাছ থেকে কী ধরনের সাহায্য পেতে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে সম্ভবত ও (কোহলি) কোনো আভাস পেয়েছে।’
এর পাশাপাশি বিসিসিআইয়ের সৌরভের বোর্ডের ভূমিকা আর নিজের ব্যাট হাতে রানখরাও কোহলির সিদ্ধান্তে ছাপ ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে মাঞ্জরেকারের, ‘বিসিসিআইয়ে রদবদলও বিরাটের এত গুরুত্বপূর্ণ সব ঘোষণার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এটা পরিষ্কার, ওকে দেখে মনে হচ্ছে এমন একজন, যে কিনা স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারছে না। ব্যক্তিগত দিক থেকে দেখলে ওর ব্যাটিং এখন সেরা অবস্থায় নেই। সবকিছু মিলিয়েই এমন ঘোষণাগুলো আসছে। ও এই মুহূর্তে সবদিক মিলিয়ে ভালো অবস্থায় নেই। আর সবাই-ই তো বোঝে যে এই সিদ্ধান্তগুলো আসলে আবেগ থেকে আসে।’
যেভাবেই আসুক, কোহলির ঘোষণায় নিশ্চিত হয়ে গেল, ভারতের ইতিহাসের সফলতম টেস্ট অধিনায়কের মেয়াদ শেষ হলো। লাল বলের ক্রিকেটে ভারতকে ৬৮ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০টিতে জিতিয়েছেন কোহলি, তাঁর অধীন ভারত টেস্ট হেরেছে ১৭টি।
No comments